চটুল একটা গানের সুর ভাজতে ভাজতে হাত নাড়িয়ে রাস্তা দিয়ে একাকী হেঁটে আসছিল বাম হাতে শাড়ির কুঁচি একটু উঁচিয়ে রাস্তার খুচরো পাথর খণ্ডগুলোকে লাথি মারতে মারতে। নিস্তেজ হয়ে আসা বিকেলের আলো গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঝুলে ছিল। কিছু আবার খসে পড়ে লাল করে দিচ্ছিল মিষ্টির গাল দুটো। খুব আনন্দে আছ আজ।
একটা ছোট্ট ভাঙ্গা ডাল ডান হাতে বৃত্তাকারে(ওপরে-নিচে) ঘোরাতে ঘোরাতে লেকের ধারে পেয়ে গেল আনুকে। মাথা নিচু করে নিক্তিতে বাদাম মাপছে—সামনে দাঁড়ানো দুটো কৈশোর পেরুনো ছেলে। ‘আইনা দুই টাকার বাদাম দে।’ ‘দুই টাকার কোনও বাদাম নাই।’ হাতে কাগজের কোণ বানাতে বানাতে বলল। ‘দে-না রে..’ এই বলে এক খাবলা তুলে নিয়ে দুই টাকা ছুঁড়ে দিয়ে দাঁতের নিচে একটা বাদাম ফেলে মটোস্ করে খোসা ভাঙ্গল।
রনিকে দেখে ডাক দিল, ‘বন্ধু এক কাপ কড়া চা দিয়ে যা—লেবু আছে তো’?
সকালের ঘুমটা ভাল হয়নি। ‘রাতের মোটকা শুয়োরটা একটুও ঘুমনোর সুযোগ দেয়নি। পারুক আর না পারুক... শালা... সারারাত জ্বালিয়ে ছাড়ল আর বখশিশ দেয়ার সময় পকেট খালি।’
‘খুব আনন্দ দিয়েছ...’ ‘কিন্তু বকশিস কই?’ ‘সামনের বার দেব... নয়টার দিকে তখন বাইরে গেলাম-না? বিকাশ করতে গিয়েছিলাম—বউয়ের বড় ভাই এসেছে, সকালে বাপের বাড়ি যেতে চাচ্ছে। তাই কিছু টাকা পাঠাতে হল। রাগ কোরো না।’ একটা ছোঁ মেড়ে হাত থেকে ওয়ালেটটা নিয়ে নিল মিষ্টি। ‘ঠিক আছে, রেখে দাও। নতুন— মাত্র এক সপ্তাহ হয় কিনেছি। শুধু যাবার ভাড়াটা দাও।’
রিক্সায় উঠে ওয়ালেট হাতরে দেখতে লাগল। একটা ভাঁজে বাসের টিকেট, হোটেল রশিদ, ফোন চার্জারের ওয়ারেন্টি কার্ড, আরও কিছু আজেবাজে কাগজের টুকরোর সঙ্গে একটা লটারির টিকেট পেয়ে গেল। সবগুলো কাগজ কুটি কুটি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। লটারির টিকেটটা পেঁচিয়ে বিড়ির মত তৈরি করল। ভাবল টিকেট কেনার কথা হয়ত ভুলে গিয়েছে, মিলিয়ে থাকলে তো ফেলে দিত।
সংবাদপত্রের দোকান সামনে পড়ায় রিক্সা থামিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করল ‘ভাই লটারির ফল বারাইছে না কি?’ ‘হ্যাঁ পরশু দিন বারাইছে।’ ‘ঐ দিনের একটা পেপার দেন।’ ‘তিন দিনের পেপার তো রাখি না। দেখি ফটোকপি মনে হয় আছে।’
বাসায় ফিরে দু পা চৌকিতে ঝুলিয়ে দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে বিছানায় ধরাম করে পড়ে রইল। সাহানা এখনও ফেরেনি। এখন আবার রান্না চড়াতে হবে। ওরা দুইজন আট ফুট বাই আট ফুট এই ঝুপড়িতে থাকে। কিছুটা তন্দ্রার ভাব চলে এসেছিল—হঠাৎ খেয়াল হল লটারির কথা। উঠে ব্যাগ থেকে লটারির ফল বের করে বিছানায় বেছাল। বাম হাতে টিকেট ধরে ডান তর্জনী দিয়ে একটি একটি করে সংখ্যা মেলাতে লাগল।
তখনই ঘটল ব্যাপারটা বুকের মধ্যে ছ্যাত করে উঠল—বুক ফেটে সব যেন বেরিয়ে পড়বে— ছয় লাখ টাকা... উত্তেজনায় ক্ষুধার কথা ভুলে গেল। স্নান সেরে গা ভরে বডি স্প্রে ছেটাল। সবচেয়ে ভাল শাড়ি-ব্লাউজ গায়ে চাপাল। কপালে টিপ পরল। জমানো অংশ থেকে এক থোক টাকা নিয়ে, পিঠে সিক্ত চুলরাশি ছড়িয়ে যাত্রা করল নারায়ণগঞ্জ —বোনের বাসার উদ্দেশে।
বোনাই কাজে চলে গেছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বোন একা। ভাগ্নে-ভাগ্নি এত এত চকলেট, বিস্কুট পেয়ে আত্মহারা। বোনের জন্য আনা হরলিক্স দিতে গিয়ে বলল ‘তোর শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে, নিতু হবার পর থেকে। নে এটা।’ ‘একটা বয়ম খেয়ে আর কী হবে রে? পেটে ঠিক মত ভাতই জোটে না ...’ মিষ্টি কোঁচকানো বিছানার চাদর টান দিয়ে বলল ‘তোকে আমি কিছু টাকা দেব—সংসারে খরচ করবি না। ভালমতো চিকিৎসা করা।’
দুপুরে খাবার খেতে মেরাজুল বাসায় আসে। শ্যালিকাকে দেখে রসিকতা করে বলল ‘ঘন ঘন আসো না, তাই ভাল-মন্দ খাওয়াই হয় না। আজ আশা করি আজ ...?’ ‘ইহ কত টাকা উনি রেখে গেছেন! মেহমান এলে আমি পোলাও কোর্মা করি!’ ‘হবে হবে সব হবে, একটু ধৈর্য ধরো ...’ ‘তাতো হবেই আমি মরলে ...’ মিষ্টি রাগত স্বরে বলল ‘তোরা এসব করলে কিন্তু এখনই চলে যাব।’
দুপুরে খেয়েদেয়ে বিছানায় বসে বোনের কাছে পান চাইল মিষ্টি। মুখে পুড়ে একটা ঢোক চিপে বলল ‘ ভাবছি বাবা-মাকে নিয়ে আসব। দোকান-টোকান কিছু একটা করে দেব। শুনেছি খেলনা বিক্রিতে লাভ বেশি, পুঁজিও তেমন একটা লাগে না।’ ‘টাকা পাবি কোথায়! আমার কাছে কিছু নেই কিন্তু!’ ‘না না তোকে সেসব ভাবতে হবে না। ফ্যাক্টরিতে কিছুদিন হয় নিয়মিত ওভারটাইম করলাম। হাতে কিছু জমেছে।’ লটারির কথা বলতে নিয়েও বলল না—যদি বোন-জামাই আবার চেয়ে বসে! ‘কিন্তু বাড়ি খালি করে সবাই চলে আইলে, বাড়ির কী অবস্থা হবে?’ ‘কী আবার? যা হবার তাই হবে—যমুনার পেটে যাবে। থাকলেই আর কত কী বাঁচানো যায়—বড় জোর ছাপরাটা। এই নিয়ে কতবার ঘর ভাঙ্গলাম বলতো? বছর বছর ঘর ভাঙ্গে আর বাপের পুরনো কালের কেচ্ছা—গোয়াল ভরা গরু, ডোল ভরা ধানের গল্প ভাল লাগে না।’ ‘কথা তো মিথ্যা না।’ ‘তুই তো আর দেখস নাই তাইলে সত্যি ভাবস কেমনে? শোন বু— যাদের বর্তমান অন্ধকার, ভবিষ্যতের কোনও সম্ভাবনা নেই, তাদের কেবল উজ্জ্বল একটা অতীত থাকে।’ মিষ্টি কিছু কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়ে সুযোগ মত। একটু আধটু কাব্য করে কথা বলতে পারলে শিক্ষিত খদ্দেররা ভাল বকশিস দেয়।
মানুষের মনে নিজের অজান্তে অনেক রহস্য লুকিয়ে থাকে। সেসব অপ্রকাশিতই থেকে যায়। তারই কিছুটা গল্পে আনতে চেয়েছিলাম। টাকা পেলে মানুষের আচরণে যে একটা পরিবর্তণ আসে, নারীও পুরুষের(পতিতা গমনকারী) মত হয়, তারও কামনা-বাসনা আছে, সেটাই ছিল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ রহস্যভরা মন... সে যাক মনে হয় সফল হইনি। অনেক ধন্যবাদ।
সেলিনা ইসলাম
চমৎকার গল্পের পটভূমি...! গল্পের ধারাবাহিকতা কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে রহস্য রাখতে গিয়ে। যা আর একটু খেয়াল করলে উতরে যাওয়া যেত। এছাড়া যতি চিহ্ন ব্যবহারে এবং বাক্য গঠনে আরও সতর্ক হতে হবে। সবমিলিয়ে ভালো হয়েছে গল্প। আরও ভালো ভালো গল্প পড়ার প্রত্যাশায় শুভকামনা রইল।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।